নারীর মনের খবর কতটা জানেন?

একহাতে সামলানো। কথার কথা হলেও নারীকে তার দুই হাতে করতে হয় দশ রকমের কাজ। দশোভূজা নারী যখন সংসারে সব দেখাশোনা করেন, সন্তানের পড়াশোনা থেকে শুরু করে রান্নাঘরের তেল-নুনের খবরটিও নারীকে রাখতে হয় নখদর্পনে। সেই মা কিংবা স্ত্রীর কতটুকু খবর আমরা রাখি? মা কিংবা স্ত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে যেখানে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময়টুকু আমাদের হয় না সেখানে আবার মানসিক স্বাস্থ্য, সেটাতো অনেক পরের বিষয়।

আমাদের সমাজে নারীরা শারীরিক অসুস্থতা, অপর্যাপ্ত ঘুম, সাংসারিক কাজ, যৌন নির্যাতন, ইভটিজিং, পারিবারিক নির্যাতনসহ নানা ধরনের মানসিক চাপে থাকেন। আবার মেনোপজ, গর্ভকালীন বিষন্নতা, বয়ঃসন্ধিক্ষণসহ কিছু প্রাকৃতিক নিয়মের কারণেও নারীরা বিষন্নতা, হতাশা, কাজে অনীহাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন। কিন্তু এটাকে অসুখ বলে গণ্য করার প্রবণতা এখনো তৈরি হয়নি আমাদের সমাজে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ১৮ শতাংশের বেশি বিষন্নতায় আক্রান্ত, যাদের অধিকাংশই নারী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ দীবা জানালেন, ‘পারিবারিক নির্যাতনের শিকার অবহেলিত এসব নারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। এ থেকে নারীর মনের মধ্যে জন্ম দেয় গভীর হীনম্মন্যতাবোধ, হতাশা, আড়াল করার প্রবণতা, রাগ, ক্ষোভসহ নানা কিছু। নারীর এই মানসিক অবস্থা যে মানসিক অসুস্থতা তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না বা বুঝতে চাইও না। ফলে মানসিক এই অবস্থা এক সময় নারীকে মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত করে তোলে, যা নারীকে কখনো কখনো ঠেলে দেয় আত্মহত্যার পথে। কখনো বা তারা হত্যা করে বসে সন্তান, স্বজনকেও। কেউ আবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কেউ বা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।’

ফারাহ দীবা আরো বলেন, ‘আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় তুমি মেয়ে। এটা তোমার করা উচিত, এটা করা উচিত নয়। এতে শৈশব থেকেই মেয়েশিশুরা মানসিক বিপর্যস্ততা নিয়ে বড় হতে থাকে। জীবনে প্রতিটি ধাপেই নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাবা হয়। এতে নারীর ভেতর হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যা নারীকে বিপথগামী করে তুলতে পারে। নারীর মানসিক সুস্থতার জন্য শৈশব থেকেই তাকে সুন্দর পরিবেশ দিতে হবে, এতে সে ছোটবেলা থেকেই মানসিকভাবে দৃঢ় হবে। নারীরা মন খুলে তার মানসিক অবস্থার বিষয়ে কথা বলতে পারে না। অথচ মন খুলে কথা বলতে পারলে আর কাউন্সেলিং নেওয়ার সুযোগ পেলে নারীদের অনেক মানসিক সমস্যাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’

‘নারীর জীবনের মেনোপজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মেনোপজের সময়টাতে নারীদের মাঝে বিরক্তির উদ্রেক, দুশ্চিন্তা, ভালো না লাগা, রেগে যাওয়া, খাবারে অনীহাসহ অসংখ্য মানসিক পরিবর্তন শুরু হয়। এ রকম মানসিক পরিবর্তন দেখা যায় বয়ঃসন্ধিক্ষণের সময়টাতেও। এছাড়া গর্ভধারণে অক্ষমতা, গর্ভপাত, ছেলে সন্তান না হওয়া নিয়ে উৎকণ্ঠা, গর্ভবতী অবস্থায় হীনম্মন্যতাবোধ, বিষন্নতা নারীর মানসিক চাপ অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়’Ñ জানান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের গাইনী ও অবস বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফারহাত হোসেন।

কর্মজীবী নারীরা কর্মস্থলে পুরুষ আধিপত্যের কারণেও মানসিক চাপে থাকেন। পুরুষ আধিক্যে কাজ করতে গেলে নারীদের লিঙ্গ বৈষম্য, সমসুুযোগের অভাব, যৌন হয়রানি, কাজের চাপ ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানান, পুরুষশাসিত কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে নারীদের মানসিক চাপ বেড়ে যায়, যা বিভিন্ন অসুখের জন্ম দেয়।

ফারাহ দীবা আরও বলেন, ‘অনেক সময় মানসিক রোগীর মেজাজ বা মুড পরিবর্তন চক্রের মধ্যে আবর্তিত হয়। কোনো সময় উত্তেজনা ও উন্মত্ততায় মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, আবার কখনো অহেতুক দুঃখে মন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এটা কয়েক ঘণ্টা বা মিনিটের ব্যবধানেও যেমন হতে পারে, তেমনি কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক মাসও চলতে পারে। এই ধরনের ভাব পরিবর্তন দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের ফল বলে মনে হতে পারে। ফলে এটা যে মানসিক সমস্যা তা নিকটজনও বুঝে উঠতে পারেন না।’

ভালো স্বাস্থ্য মানে মানসিক আর শারীরিক দুই দিক থেকেই সুস্থ বা ঠিক থাকা। অনেকের বেলায় দেখা যায়, শরীর ঠিক থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্ব দেন না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন ঠিকমতো চালিয়ে নিতে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জীবনযাপনে সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে সব মানসিক সমস্যা দূরে ঠেলে মনকে ফুরফুরে করে তুলতে পারেন। এ রকম সহজ কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে পারেন।

নিয়মে চলুক জীবন
দৈনিক কাজের একটি নিয়ম দাঁড় করান। সময়ের কাজ সময়ে করুন। নিয়ম মেনে খাওয়া, ঘুম থেকে জাগা বা বিছানায় যাওয়ার বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য দরকারী। যারা নিয়ম মেনে চলেন, তাদের মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে সুস্থ থাকার হার বেশি বলেই গবেষণায় দেখা গেছে।

সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন
মানসিকভাবে ভালো থাকতে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাটাও জরুরি। শরীরকে সক্রিয় রাখতে সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যায়াম করুন। ব্যায়াম করলে সুখ হরমোন নিঃসৃত হয়। মানসিকভাবে হালকা বোধ করতে বা মন ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের চর্চা করে যান।

খাবার-দাবার হবে পুষ্টিকর
পুষ্টিমানসম্পন্ন ও সুষম খাবার খাবেন। খাবারের তালিকায় বেশি করে ফল আর সবজি রাখুন। মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত রাখে এমন খাবার, বিশেষ করে বাদাম কিংবা পালংশাকের মতো খাবার খান।

যন্ত্র থেকে দূরে
এখনকার সময় মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন কিংবা মনোযোগ কেড়ে নেওয়া নানা যন্ত্র রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যতটা সম্ভব যন্ত্রের ব্যবহার সীমিত করুন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে মোবাইল ফোনসহ যন্ত্র ব্যবহার বাদ দিন। এমনকি দিনের বেলাতেও যন্ত্র যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।

মস্তিষ্কের ব্যস্ততা
সংবাদপত্র পড়ে, পাজল মেলানো, ক্রসওয়ার্ড সমাধান করার মতো নানা কাজে মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখুন। মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকলে স্মৃতিশক্তি উন্নত হবে, এমনকি শেখার দক্ষতা বাড়বে।

এডিটর-ইন-চিফ : মাহমুদ হাসান সোহেল
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : আবু বকর সিদ্দিক সাগর
নিউজরুম মেইল: khulnanews24@gmail.com এডিটর ইমেইল : editor@khulnanews.com
Khulna Office : Chamber Mansion (5th Floor), 5 KDA C/A, Jessore Road, Khulna 9100,
Dhaka Office : 102 Kakrail (1st Floor), Dhaka-1000, Bangladesh.
কপিরাইট © 2009-2020 KhulnaNews.com